![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2020/03/blog11-1024x680.webp)
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2023/09/IMG_1857-removebg-preview.png)
১
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
মণিভূষণ ভট্টাচার্য।
এখনো পূর্ণিমা রাত্রে আলো হয়। আলোর স্বভাবে
স্খলিত তরঙ্গধ্বনি বুনো ঝোপে কিংবা চূর্ণ পাথরের দেশে
ছিন্নভিন্ন জনপদে; বস্তিতে আসল অন্ধকারে
ধনুষ্টঙ্কারের বীজ বেড়ে ওঠে, কারণ শতাব্দী জুড়ে বাঘা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী
কয়েকটি কুটিল অশ্ব রেখে গিয়েছিল, ব্যক্তি কিংবা শ্রেণীগতভাবে আজ,
মনে হয়, তথ্যগুলি ধরা পড়ে গেছে। আর ঠিক সেই ক্ষণে
চোয কাগজের মত স্তরে স্তরে জমাট বণিকী অন্ধকারে
কলকাতার আংশিক উত্থান ;যেন সমগ্রের প্রতিভাস নিয়ে,
কেবল পড়ে না ধরা অপুষ্ট শিশুর চোখে ধীরে ধীরে পোহালে শর্বরী
বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে : তুমি, মানসযাত্রায়
উৎকণ্ঠার প্রতিনিধি : কর্মঠ কব্জির নীচে ঘাম জমে, অশ্রু ও স্বপ্নের
সমুদ্রে উত্থিত এক কঠিন প্রবাল দ্বীপ : চতুর্দিকে জাগরণ স্রোতে
ভাসমান বাণিজ্যতরণী, সংঘ কিংবা প্রতিষ্ঠানহীন সেই জ্যোৎস্নার গঠনে
নির্মিত মানুষ আর মানুষের প্রাণের জাহ্নবী
তুমি সেই প্রাণপুরুষের নেতা, কিংবা নেতা নয়, নবীন প্রণেতা
আপন স্বভাব ঘিরে জেগে ওঠো, স্তব্ধ হয় স্বভাবের সীমা
তখনই পর্বতমালা অতিক্রম করে দূর অরণ্যসীমার
শতাব্দী শশাঙ্ক হয়ে ঢলে পড়ে, যদিও তা অষ্টমীর চাঁদ-
তবু তারই অবসানে ঊষার সঞ্চার, সম আয়তনে সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের চতুর্দিকে
জনস্রোত, দিনযাপনের শক্তি, প্রকাশ্যে বীরত্বহীন বিরক্ত বীরের রক্তধারা-
ইতস্তত অপসৃত অন্ধকারে মুর্গীচোর শেয়ালের পদধ্বনি—আর
কেবল পূর্ণিমা-শেষে স্যাঁতস্যাঁতে লোকালয়ে তোমার ক্ষমতা, ঘরে ঘরে
স্বল্পায়ু শিশুর হাতে বর্ণপরিচয়, মলাটে অস্পষ্ট চিত্র, আলেখ্যদর্শন।
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2023/09/0E3E0F84-E47E-4D29-B865-8C495151AFB4.jpg)
২
বিদ্যাসাগরের চরণছাপ
সমরেশ দেবনাথ
দিনান্তে প্রণাম রেখে যাচ্ছে।
ভাষা দিবস-
তাকে ফেরাও মৃৎ কৌশল দিয়ে
মাটি জানে ভাষার গণসংযোগ।
ভিনদেশী এসে ধমক দিলেই
ভেঙে যায় না দেহ ও আত্মার সম্পর্ক।
বাংলা অক্ষরের টানে
ঘর থেকে বের হয়ে গেছে অনেকেই
দুপুরে ঘুঘু অবিরাম ডাকে
যারা গেছে, তারা ফেরেনি আর
মিঠেপুকুরের পাড়ে শিস দিতে গিয়ে।
একটি তিতির দীর্ঘদিন
রবীন্দ্রনাথ হয়ে আছে-
দোয়েলের কাছে গেলেই
জীবনানন্দ কথা বলেন নক্ষত্রের প্রান্ত থেকে-
যার দীর্ঘ উত্তাপে
বাংলা আজ সাবালক!
হাসান-রুদ্র অনুজ দুজন
চলে গেছে শূন্যতার ব্যাকরণ জানতে—
অথচ এই ভাষা-মৃত্তিকা থেকে
যে ব্যাকরণ তৈরি হচ্ছে।
তাতে রয়েছে বিদ্যাসাগরের
চরণছাপ।
৩
এ কেমন বিদ্যাসাগর
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলি আজ
হাজার টুকরো হয়ে
হাজার জায়গায় ছড়িয়ে আছে।
আমার বালিকাবয়সী কন্যা যেমন
নতজানু হয়ে
তার ছিন্ন মালার ভ্রষ্ট পুঁতিগুলিকে
একটি একটি করে কুড়িয়ে নেয়,
আমিও তেমনি
আমার ছত্রখান সেই বিখত জীবনের হৃৎপ্রদেশে
নতজানু হয়ে বসি,
এবং নতুন করে আবার মালা গাঁথার জন্যে
তার টুকরোগুলিকে
যত্ন করে কুড়িয়ে তুলতে চাই।
কিন্তু পারি না।
আমারই জীবনের কয়েকটি অংশ আমার
হঠাৎ কেমন অচেনা ঠেকতে থাকে,
এবং কয়েকটি অংশ আমাকে চোখ মেরে আরও
দূরে গড়িয়ে যায়।
আমি বুঝতে পারি,
গঙ্গাতীরের তীর্থের দিকে পা বাড়ালেই এখন
বৃত্রাসুর আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। এবং
মাসির কান কামড়ানো সেই ছেলেটা কিছুতেই আমাকে
বাদুড়বাগানে পৌঁছতে দেবে না।
স্তব্ধ হয়ে আমি বসে থাকি।
উইয়ে খাওয়া বইয়ের পাতা হাওয়ায় উড়তে থাকে।
আমি চিনে উঠতে পারি না যে,
এ কেমন হেমচন্দ্র, আর
এ কেমন বিদ্যাসাগর।
তখন পিছন থেকে আমি আবার
সামনের দিকে চোখ ফেরাই।
এবং আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে,
অতীতের সঙ্গে সম্পর্কহীন
বর্তমানের এই কবন্ধ কলকাতাই আমার নিয়তি ;
যেখানে
‘কবিতীর্থ’ বলতে কোনো কবির কথা কারও মনে পড়ে না,
এবং ‘বিদ্যাসাগর’ বলতে—
তেজস্বী কোনো মানুষের মুখচ্ছবির বদলে
ইশকুল, কলেজ, থানা, বস্তি, অট্টালিকা, খাটাল, পোস্টার ও পয়ঃপ্রণালী-সহ
আস্ত একটা নির্বাচনকেন্দ্র আমার
চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2020/03/blog13-1024x680.webp)
৪
কার্মাটার আজো কাঁদে
মানস কুমার মাইতি
নাম বৃষ্টি ওঝা। ক্লাস ইলেভেন ।পটলচেরা চোখ ।যার মুখ জুড়ে ভেসে উঠতো সবুজ পল্লীর স্নিগ্ধতা ।মেরে কেটে মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো । সুন্দর গড়ন। তার লম্বা খোলা চুলে ঢলে পড়তো রক্তিম বিকেল। কিন্তু হায়নাদের নজর পড়েছে তার শরীরের উপর। বাড়িতে আসতে লাগলো প্রস্তাবের পর প্রস্তাব । বয়স বাড়লে ঝুলে যাওয়া চামড়ায় চোখ ধাঁধানো রূপটা চলে যেতে পারে। যাকে বলে -এখন সে কচি মেয়ে কারণ মেয়েদের নাকি কুড়ি পেরোলেই বুড়ি । এই সময় বিদেয় করতে পারলে -প্রায় ফ্রিতে বা অনেক কম খরচে কাজটা হাসিল হতে পারে কিন্তু বয়স বাড়লে আসতে থাকা সুযোগগুলো হয়তো আর পাওয়া যাবে না। এই ভয়ে বৃষ্টির বাবা রতন ওঝা আতঙ্কিত। খেটে খাওয়া লোকটি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো , মেয়েকে বিদায় করার । বৃষ্টির ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপা পড়লো প্রখর দহনে। দারিদ্রতার নীল ব্যথায় সেই পৃথিবী এখনো খুব ক্লান্ত। লাঞ্ছিত মানুষের কান্না প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা। বৃষ্টির কাছে দৃশ্যগুলো অবশেষে ঝড় হয়ে ওঠে। তছনছ হয় প্রহর। এতো আর শহরের জলছবি নয়, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের বাস্তব গভীর যন্ত্রণা। বৃষ্টির বিয়ের রজনীগন্ধা মালাটা আস্তে আস্তে অভিযোগ আর অন্যায় শাসনে ভরে উঠলো। ঋতুমতী হলেই শাশুড়ির কড়া ধমক – বৌমা, তুমি আজ তুলসী তলায় সন্ধ্যা দেবে না তাহলে বাড়ির অমঙ্গল হবে। এইসব শুনে শুনে বৃষ্টিতো মেঘহীন রোদে পুড়তে পুড়তে বেলে পাথরের মত শক্ত হয়েছে। বৃষ্টি হলো সমাজের কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা শ্রাবণের- আঝোর কান্না , আমরা যাকে ‘নিয়ম’ বলে বুক ফাটাই ।সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকা মাতাল স্বামীর অত্যাচার ও লালসা মুখ বুজে সহ্য করতে করতে বৃষ্টি ও একদিন মা হলো। জন্ম নিলো ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। ব্যাস- মেয়ের জন্ম দিয়েছে বলে চললো অকথ্য গালিগালাজ আর জন্ম অশৌচের খপ্পড়ে পড়ে বন্ধ হল বাড়ির পবিত্র পুজো । দুশোটি বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু দুশোটি অন্ধকার পেরোতে পারলাম কই?? বৃষ্টির শুধু মনে পড়ে ক্লাসে বলতে থাকা প্রদীপ স্যারের সেই কথাগুলো। “একটি জাগরণের নাম- বিদ্যাসাগর, নারীমুক্তির নাম- বিদ্যাসাগর, একটি কুসংস্কারমুক্ত সমাজের নাম বিদ্যাসাগর। ” ইসরোর মঙ্গলযান অভিযান, নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র, আর এয়ার স্ট্রাইকের আড়ালে সমাজের কুসংস্কারের জঘন্য স্ট্রাইকগুলো রোখা গেলো না । প্রকৃত বর্ণের সাথে পরিচয় হলো না আমাদের এখনো। বিদ্যাসাগর, তোমার কার্মাটার এখনো কাঁদে যখন সাঁওতাল নিরীহ একটা বুড়িকে ডাইনি বলে পিটিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়।মৃত বুড়িটির বামগাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া কাঁচা রক্ত হলো আধুনিক সমাজ, তার ডানগাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া কালচে রক্তই হলো তোমার সযত্নে লালন করা নারীর মুক্তি। আজ দুশোটা বছরের পরেও- তোমার কার্মাটার কাঁদছে, ভীষণ কাঁদছে ,,,,, ।
৫
বর্ণপরিচয়
দেবেশ ঠাকুর
প্রকৃতির খেয়ালিপনায় কোথাও উঁচু পাহাড়, কোথাও সমুদ্র ,
খুব উঁচু পাহাড় কিম্বা খুব গভীর সমুদ্র
প্রায় একসঙ্গে দেখা যায় না
তবু
তুমি আছো বলেই আজও গভীর নিবিড় বর্ণমালা
সন্দিপনী পাঠশালাতে ভুবনমালা – কুন্দমালা
তুমি আছো বলেই সাদা থানের বুকে পলাশ ফোটে
হাজা মজা দহের বুকে জীবন জয়ের তুফান ওঠে
বর্ণপরিচয়ে আমার পুব আকাশে নতুন ভোরে
সূর্য এসে ঘুম ভাঙাবে পর্ণকুটির আলো করে
তুমি আছো বলে আছে কলম আমার বর্শা হয়ে
উপেক্ষিতার বুকে আছো বেঁচে থাকার ভরসা হয়ে
কন্যাদায় গ্রস্ত এক পিতার আমন্ত্রণে তুমি ভোজনে বসেছিলে ,
অতি কষ্টের আয়োজন , বিদুরের খুদকুঁড়ো ,
হায়রে , তোমার পাতে পড়ল একটি আরশোলা
দু-পাশে উপবিষ্ট পণ্ডিতগণ অর্কফলা কম্পিত করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
জানতে চাইলেন , পাতে ওটি কী!
তুমি কীটটিকে গিলে ফেলে বললে , লঙ্কাভাজা
বাঁচিয়ে দিলে সেই দরিদ্র ব্রাহ্মনের মান
দেনায় জর্জরিত মধুসূদনকে ফিরিয়ে আনলে প্যারিস থেকে
রক্ষা করলে কারান্তরাল থেকে।
মধুসূদনকে বাঁচাওনি , বাঁচাওনি হেনরিয়েটা বা তার সন্তানদের
বাঁচালে বাংলা ভাষাকে , বাংলা সংস্কৃতিকে , ভারতীয় রীতিকে
‘ তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথা মা গৃধ কস্যসিদ্ধনম’-
মধুসূদন ঋনশোধ করে লিখলেন,
‘…করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে। দীন যে দীনের বন্ধু’-
শত গালাগাল শত কুৎসা সয়েও
মাথা উঁচু করে বেঁচেছো , বাঁচতে শিখিয়েছো আমাদের
বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে দরখাস্তে দশ হাজার জন স্বাক্ষর করেছিলেন
তাঁরা হারিয়ে গেছেন , যেমন দিনের সূ্র্যালোকে জোনাকি হয় অদৃশ্য
সমালোচনার আঘাতে জর্জরিত , নিন্দিত
তবু নন্দিত আজ বাংলার ঘরে ঘরে
আমার প্রথম প্রেমিক আজো ‘বর্ণপরিচয়’
দুহাতে জড়িয়ে বুকে চুমু খেয়ে আজো কাছে টানি
আদর্শের সঙ্গে সংঘাতে একমাত্র পুত্রকে ত্যাগ করেছ ,
ভয় করোনি পুন্নামের ,
আদর্শের জন্যই সরকারী চাকরি , স্বগ্রাম ,
এমনকি গর্ভধারিণীকেও ত্যাগ করতে পিছপা হওনি
সত্য যে সব লোকাচারের উর্ধে
কে বুঝেছে তোমার মতন !
‘বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’
প্রতিটি শাড়ির পাড়ে প্রতিটি নারীর জাগরণে
সত্যের সারথ্যে , প্রতিটি নিবিড় যুদ্ধজয়ে
শিক্ষায় আদর্শে , সভ্যতার নব উত্তরণে ।
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2023/09/IMG_1857-removebg-preview.png)
৬
সাগরদীপ বিদ্যাসাগর
সুমন বিশ্বাস
মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছো ইস্কুলে ইস্কুলে।
ছবি হয়ে আছো তুমি দেওয়ালে দেওয়ালে।
অক্ষরের মাঝে আছো তুমি বর্নপরিচয়ে,
সোজা শিরদাঁড়ায় আছো, আছ বরাভয়ে।
সেতুতে আছো, হেতুতে আছো, হাজার নামের ভীড়ে।
দাঁড়িয়ে আছো আজও তুমি জ্ঞানের সাগর তীরে।
দয়ার সাগর, দানের সাগর, জ্ঞানের সাগর তুমি।
দুশো বছর পেরিয়ে এসেও তাইতো তোমায় নমি।
বীরসিংহের সিংহ শিশুর জগৎ জোড়া নাম,
তোমার জন্যে ধন্য হল বীরসিংহ গ্রাম।
মায়ের টানে সাঁতরে নদী এলে তুমি বাড়ি,
তোমার সেবায় হার মেনেছে কলেরা মহামারী।
সাধারণের বেশভূষাতে চাদরে খদ্দরে,
মোট বয়েও শিক্ষা দিলে মানব সাগর তীরে।
দেশে তখন বড্ড অভাব, ভাত জোটে না মোটে,
তখন অন্নসত্রে অভুক্তদের মুখে হাসি ফোটে।
বাঙালী জাতির জনক তুমি, নতুন যুগের দূত,
তোমার জাদুতে পালিয়ে গেল কুসংস্কারের ভূত।
বিধবাবিবাহ চালু হল, খুললো মেয়েদের স্কুল,
নারীমূক্তির পথ চলাতে ভাঙলে সবার ভুল।
শিক্ষার দীপ জ্বলছে যখন সারা বাংলা জুড়ে,
পরমহংস মিললো এসে সেই সাগরের তীরে।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালাতে মেয়েরা এলো পড়তে,
শিক্ষিত মায়েরাই পারে সোনার ভারত গড়তে।
“সংস্কৃত যন্ত্রে” তোমার ছাপলো হাজার বই,
আজও তোমার সৃষ্টিতে তাই বিভোর হয়ে রই।
তোমার সেবায় ধন্য হল কার্মাটাড়ের ভূমি,
বঞ্চিত সেই মানুষগুলোর ঈশ্বর তো তুমিই।
বাংলা জুড়ে গড়েছো তুমি কত যে ইস্কুল,
সে পাঠশালায় বর্ষে বর্ষে ফুটেছে কত ফুল।
কঠিন ছিল তোমার লড়াই আঁধার দিনের কালোয়।
আলোকিত করেছো তুমি তোমার মনের আলোয়।
শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়েছিলে গ্রামে গ্রামান্তরে।
তাই, অমর হয়ে থাকবে তুমি বাঙালির অন্তরে।
তবুও তোমার মূর্তি ভাঙে দুর্বৃত্তের দল,
এসব দেখে বাঙালিজাতির চোখে আসে জল।
তুমি এদের ক্ষমা করো, এদের নেই শিক্ষার আলো।
আবার তুমি ফিরে এসে শিক্ষার দীপ জ্বালো।
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2020/03/blog12-1024x680.webp)
৭
বলি ও বিদ্যাসাগর
সুমন বিশ্বাস
বলি ও বিদ্যাসাগর? কী করে পারলে গো?
বয়স তখন নয় বছর বটেক,
বাপের সাথে চললে কোলকেতে,
রাস্তায় শিল পোঁতা দেখে শিখে নিলে ইংরিজি নাম্বার।
সেই ছোটবেলাতেই ত্যাজ ঠাওর করেছিলেন বাবা ঠাকুরদাস।
বীরসিংহের সিংহ শিশুই বটেক,
পড়াশোনা শিখে বিদ্যাসাগর অনেকেই হয়েছে,
কিন্তু তোমার পারা কাউরে চোখে পড়ে না।
এই ধর, তুমি যদি বর্ণপরিচয় না লিখতে,
তাহলে আমরা তো অক্ষরই চিনতে লারতাম।
বাংলা গদ্য তো তুমার হাতেই পিরাণ পেলো।
বলি ও বিদ্যাসাগর? কীকরে পারলে গো?
মেয়েদের ইস্কুলে পেঠিয়ে ঠুলি খোলা কি সহজ কতা?
আর বিধবাদের আবার বিয়ে দেওয়া!
সে কী করে পারলে গো?
এতো ত্যাজ তুমি কুতা থেকে পাইলে গো?
মা ভগবতী তোমায় পেটে ধরেছিলো তাই!
না হলে দেশের এই কালো আঁধার ঘুচোতো কে শুনি?
তা হ্যাঁ গো বিদ্যাসাগর, শুনেছো?
তুমার মূর্তি নাকি উয়ারা গুড়িয় দিলো!
একবার হাতটাও কাঁপলো না গো!
যে মানুষটা একখান খড়ম আর কাপড় পড়ে জীবন কাটিয়ে দিলো,
এত এত বিদ্যালয় খুললো, তার কিনা এই প্রতিদান!
হ্যাঁ গো, বিদ্যাসাগর আবার একটি বার এসো ক্যানে!
এখনও তো পাড়া গাঁয়ে বাল্যবিবাহ হচ্চে গো।
বিটি মাইয়ারা এখনও নাকি বোঝা।
তাই বাপে মায়ে বিটিদের তো বিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যায়।
তুমি একবার এসো দিকি, আবার একটা লড়াই তোমায় লড়তে হবেক।
তুমার পারা একজন মানুষ খুব দরকার বটেক।
সমাজটোকে সবক শিখাতে তুমি ছাড়া আর কে পারবেক শুনি?
বলি ও বিদ্যাসাগর ? তাহলে তুমি আসছো তো ?
৮
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বঙ্গসাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে
অখ্যাত জড়ত্বভারে অভিভূত। কী পুণ্য নিমিষে
তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা,
প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যুষের বিভা,
বঙ্গভারতীর ভালে পরালো প্রথম জয়টিকা।
রুদ্ধভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা,
হে বিদ্যাসাগর, পূর্ব দিগন্তের বনে-উপবনে
নব উদ্ বোধনগাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে।
যে বাণী আনিলে বহি নিষ্কলুষ তাহা শুভ্ররুচি,
সকরুণ মহাত্ম্যের পুণ্য গঙ্গাস্নানে তাহা শুচি।
ভাষার প্রাঙ্গণে তব আমি করিব তোমারি অতিথি,
বারতীর পূজাতরে চয়ন করেছি আমি গীতি
সেই তরুতল হতে যা তোমার প্রসাদসিঞ্চনে
মরুর পাষান ভেদি প্রকাশ পেয়েছে শুভক্ষণে।
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2023/09/Screenshot_20230910_213738_Chrome-1024x1024.jpg)
![](https://manikkaran10.co.in/wp-content/uploads/2023/09/0E3E0F84-E47E-4D29-B865-8C495151AFB4-1.jpg)
৯
বিদ্যাসাগর
মধুসূদন দত্ত
বিদ্যাসাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হিমাদ্রির হেম- ক্লান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য- বলে পেয়ে সে মহাপর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ -চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কী সেবা তার সে সুখ- সদনে!—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিংকরি ;
জোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি ;
পরিমলে ফুল- কুল দশ-দিশ ভরে ;
দিবসে শীতলশ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।
১০
বিদ্যাসাগর
শুভ দাশগুপ্ত
হে তেজোদ্দীপ্ত বঙ্গসন্তান।
আমাদের স্বভাব অনুসারে
আমরা তোমাকে পুজো করেছি।
আমাদের স্বভাব অনুযায়ী
আমরা তোমাকে ভগবান বানাতে চেয়েছি
হয়তো, পেরেওছি।
কান্নার সমুদ্র আজও উত্তাল
অজ্ঞানতার অন্ধকার আজও ভয়ঙ্কর
কর্মবিমুখ গড্ডালিকা আজও স্রোতস্বিনী।
আমরা এই ধোঁয়াশা ঘেরা শূন্যতায় দাঁড়িয়ে
তোমার কথা ভুলে
তোমার পুজো করি।
তোমার নামে লাইব্রেরি বা পথ বা সংগঠন গড়ি
উৎসব করি। আলোর বাহারে সাজাই মেলা
অন্ধকার যেমন ছিল—থেকে যায় তেমন-ই।
মাইলস্টোনের সংখ্যা পরিচয় তোমার অসামান্য মেধাকে স্মরণ করায়,
মায়ের ডাকে সাড়া দিতে তোমার ভয়হীন নদী পার হওয়া
তোমার অন্তরের মাতৃভক্তিকে তুলে ধরে।
তুমি আমাদের অন্ধকার ভেঙে আলোর বর্ণপরিচয়ে ধনী করেছো
তুমি আমাদের বিভ্রান্ত কবিকে স্বপথে এনেছো—তার হাত থেকে
আদায় করেছো ‘মেঘনাদবধ’।
তুমি গরিবের কান্নাকে তুলে নিয়েছো নিজের চোখের পাতায়।
তুমি বালবিধবার যন্ত্রণাকে পাথর করেছো নিজের বুকে
তুমি লুণ্ঠনকারী ইংরেজের মুখের ওপর তুলে দিয়েছো
স্পর্ধার চটিজুতো—আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসীর ক্রোধে।
আমরা তোমাকে ‘প্রথমভাগ’ আর ‘দ্বিতীয়ভাগে’ ভালোবেসেছি।
অক্ষরজ্ঞান সমাপ্ত করেই
আমরা চিনতে শুরু করেছি—সেইসব মহামন্ত্র
যাতে করে আখের গুছানো যায়।
আমরা কোনো এককালে
তোমাকে নির্বাসিত করেছি কার্মাটারে!
তোমার হৃদয়জোড়া ভালোবাসা আর চোখ ভরা জলকে
আমরা মূল্য দিইনি।
আজও বিধবার বিবাহ -সহজ হয়নি
আজও অশিক্ষা- অন্ধকারে অন্ধকারে ভয়াল।
সত্যিকারের বর্ণপরিচয় যা ধরা ছিল তোমার প্রতিদিনের
জীবনযাপনে,সে বর্ণপরিচয়ে আমরা পরিচিত হইনি।হতে চাইনি।
তুমি আমাদের ক্ষমা করো।