আগমনী- র গান

(১)

আমার উমা সামান্য মেয়ে নয়

আমার উমা সামান্য মেয়ে নয় ।
গিরি তোমারই কুমারী – তা নয় তা নয় ।
স্বপ্নে যা দেখেছি গিরি, কহিতে মনে বাসি ভয় ।
ওহে কারো চতুর্মুখ, কারো পঞ্চমুখ
উমা তাঁদের মস্তকে রয় ॥
রাজরাজেশ্বরী হয়ে, হাস্য বদনে কথা কয় ।
ওকে গরুড় বাহন, কালো বরন,
জোড় হাতেতে করে বিনয় ॥
প্রসাদ ভণে মুনিগণে, যোগ ধ্যানে যাঁরে না পায়,
তুমি গিরি ধন্য, হেন কন্যা,
পেয়েছ কী পুণ্য উদয় ॥

(২)

অপার সংসার,নাহি পারাবার

অপার সংসার, নাহি পারাবার ।
ভরসা শ্রীপদ, সঙ্গের সম্পদ,
বিপদে তারিণী, করো গো নিস্তার ॥
যেদেখি তরঙ্গ অগাধ বারি,
ভয়ে কাঁপে অঙ্গ, ডুবে বা মরি ।
তারো কৃপা করি, কিংকর তোমারই,
দিয়ে চরণ-তরি, রাখো এইবার ॥
বহিছে তুফান, নাহিক বিরাম,
থরথর অঙ্গ কাঁপে অবিরাম ।
পুরাও মনস্কাম, জপি তারানাম,
তারা তব নাম সংসারের সার ॥
কাল গেল কালী হল না সাধন,
প্রসাদ বলে গেল বিফলে জীবন ।
এ ভববন্ধন, করো বিমোচন,
মা বিনে তারিণী কারে দিব ভার ॥

(৩)

আজ শুভনিশি পোহাইল

আজ শুভনিশি পোহাইল তোমার ।
এই যে নন্দিনী আইল, বরণ করিয়া আনো ঘরে,
মুখশশী দেখো আসি, দূরে যাবে দুঃখরাশি,
ও চাঁদ মুখের হাসি, সুধারাশি ক্ষরে ॥
শুনিয়া এ শুভ বাণী, এলো চুলে ধায় রানি,
বাস না সম্বরে ।
গদগদ ভাব-ভরে, ঝরঝর আঁখি ঝরে,
পাছে করি গিরিবরে, অমনই কাঁদে গলা ধরে ।
পুন কোলে বসাইয়া, চারু মুখ নিরখিয়া,
চুম্বে অরুণ অধরে ।
বলে, জনক তোমার গিরি, পতি জনম-ভিখারি,
তোমা হেন সুকুমারী, দিলাম দিগম্বরে ॥
যত সহচরীগণ, হয়ে আনন্দিত মন,
হেসে হেসে এসে ধরে করে ।
কহে বৎসরেক ছিলে ভুলে,
এত প্রেম কোথা থুলে,
কথা কহো মুখ তুলে, প্রাণ মরে মরে ॥
কবি রামপ্রসাদ দাসে, মনে মনে কত হাসে,
ভাসে মহা আনন্দসাগরে ।
জননির আগমনে, উল্লাসিত জগজ্জনে,
দিবানিশি নাহি জানে, আনন্দে পাশরে ॥

(৪)

আমায় কী ধন দিবি

আমায় কী ধন দিবি তোর কী ধন আছে ।
তোমার কৃপাদৃষ্টি পাদপদ্ম,
বাঁধা আছে হরের কাছে ॥
ও চরণ উদ্ধারের মা,
আর কি কোনো উপায় আছে ॥
এখন প্রাণপণে খালাস করো,
টাটে বা ডুবায় পাছে ।
যদি বল অমূল্য পদ, মূল্য আবার কী তার আছে
ওই যে প্রাণ দিয়ে শব হয়ে, শিব বাঁধা রাখিয়াছে ॥
বাপের ধনে বেটার স্বত্ব,
কাহার বা কোথা ঘুচেছে ।
রামপ্রসাদ বলে, কুপুত্র বলে,
আমায় নিরংশী করেছে ॥

(৫)

আমায় দে মা তবিলদারি 

আমায় দেও মা তবিলদারি
আমি নিমকহারাম নই শংকরী।।
পদরত্নভাণ্ডার সবাই লুটে 
ইহা আমি সইতে নারি।
ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা
সে যে ভোলা ত্রিপুরারি॥
শিব আশুতোষ স্বভাবদাতা
তবু জিম্মা রাখ তাঁরই,
অর্ধ অঙ্গ জায়গির,
তবু শিবের মাইনে ভারী॥
আমি বিনা মাইনার চাকর
কেবল চরণধুলার অধিকারী।
যদি আমার বাপের ধারা ধর,
তবে বটে আমি হারি॥
যদি আমার বাপের ধারা ধর
তবে তো মা পেতে পারি।
প্রসাদ বলে এমন পদের,
বালাই লয়ে আমি মরি।
ও পদের মতো পদ পাই তো,
সে পদ লয়ে বিপদ সারি॥

(৬)

আমি এত দোষী কিসে

আমি এত দোষী কিসে ।
ওই যে প্রতিদিন হয় দিন যাওয়া ভার,
সারাদিন মা কাঁদি বসে ॥
মনে করি গৃহ ছাড়ি, থাকব না আর এমন দেশে ।
তাতে কুলালচক্র ভ্রমাইল,
চিন্তারাম চাপরাশি এসে ॥
মনে করি গৃহ ছাড়ি, নামসাধনা করি বসে ।
কিন্তু এমন কল করেছ কালী,
বেঁধে রাখে মায়াপাশে ॥
কালীর পদে মনের খেদে,
দীন রামপ্রসাদে ভাষে ।
আমার সেই যে কালী, মনের কালী
হলেম কালী তার বিষয়বশে ॥

(৭)

আমি কি দুখেরে ডরাই 

আমি কি দুখেরে ডরাই ।
ভবে দেও দুঃখ মা আর কত তাই ।
আগে পাছে দুখ চলে মা,
যদি কোনোখানেতে যাই ।
তখন দুখের বোঝা মাথায় নিয়ে,
দুখ দিয়ে মা বাজার মিলাই ॥
বিষের কৃমি বিষে থাকি মা,
বিষ খেয়ে প্রাণ রাখি সদাই ।
আমি এমন বিষের কৃমি মা গো,
বিষের বোঝা নিয়ে বেড়াই ।
প্রসাদ বলে ব্রহ্মময়ী,
বোঝা নাবাও ক্ষণেক জিরাই ।
দেখো, সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে,
আমি করি দুঃখের বড়াই ॥

(৮)

 আমি তাই অভিমান করি

আমি তাই অভিমান করি ।
আমায় করেছ গো মা সংসারী ॥
অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসার সবারই ।
ওমা তুমিও কোন্দল করেছ, বলিয়ে শিব ভিকিরি
জ্ঞানধর্ম শ্রেষ্ঠ বটে, দান ধর্মোপরি ।
বিনা ওমা দানে মথুরাপারে,
যাননি সেই ব্রজেশ্বরী ॥
নাতোয়ানি কাচ কাচো মা,
অঙ্গে ভস্মভূষণ পরি ।
ওমা কোথায় লুকাবে বলো,
কুবের তোমার ভাণ্ডারী ॥
প্রসাদে প্রসাদ দিতে মা, এত কেন হলে ভারী
যদি রাখ পদে, থেকে পদে,
পদে পদে বিপদ সারি ॥

(৯)

ও মন ,তোর নামে কী নালিশ দিব

‌ও মন, তোর নামে কী নালিশ দিব ।
ও তুই সকার বকার বলতে পারিস,
বলতে নারিস দুর্গা শিব ।
খেয়েছ জিলিপি খাজা, লুচি মন্ডা সরভাজা ।
ওরে শেষে পাবি সেসব মজা, যখন পঞ্চত্ব পাব ॥
পাঁচ ইন্দ্রিয়ের পাঁচ বাসনা,
কেমন করে ঘর করিব ।
ওরে চুরিদারি করিলে পরে,
উচিত মতো সাজাই পাব ॥

(১০)

ভুলালে ভুলব না গো

আর ভুলালে ভুলব না গো ।
আমি অভয়পদ সার করেছি,
ভয়ে হেলব দুলব না গো ॥
বিষয়ে আসক্ত হয়ে, বিষের কূপে উলব না গো ।
সুখ দুঃখ ভেবে সমান,
মনের আগুন তুলব না গো ॥
ধনলোভে মত্ত হয়ে, দ্বারে দ্বারে বুলব না গো ।
আশা-বায়ুগ্রস্ত হয়ে, মনের কথা খুলব না গো ॥
মায়াপাশে বদ্ধ হয়ে, প্রেমের গাছে ঝুলব না গো
রামপ্রসাদ বলে দুধ খেয়েছি,
ঘোলে মিশে ঘুলব না গো ॥

(১১)

এবার আমার উমা এলে

গিরি ! এবার আমার উমা এলে,
আর উমা পাঠাব না ।
বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনব না ॥
যদি আসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয়,
এবার, মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া,
জামাই বলে মানব না ॥
দ্বিজ রামপ্রসাদ কয়, এ দুঃখ কি প্রাণে সয় ;
তিনি শ্মশানে মশানে ফিরে,
ঘরের ভাবনা ভাবে না ॥

(১২)

এমন দিন কি হবে তারা

এমন দিন কি হবে তারা ।
যবে তারা তারা তারা বলে,
তারা বয়ে পড়বে ধারা ॥
হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে, মনের আঁধার যাবে ছুটে,
তখন ধরাতলে পড়বে লুটে, তারা বলে হব সারা ॥
ত্যজিব সব ভেদাভেদ, ঘুচে যাবে মনের খেদ,
ওরে শত শত সত্য বেদ, তারা আমার নিরাকারা
শ্রীরামপ্রসাদ রটে, মা বিরাজে সর্বঘটে,
ওরে আঁখি অন্ধ, দেখো মাকে,
তিমিরে তিমিরহরা ॥

(১৩)

জয় কালী জয় কালী বলে

জয় কালী জয় কালী বলে,
জেগে থাকোরে মন ।
তুমি ঘুম যেয়ো নারে ভোলা,
মন ঘুমেতে হারাবে ধন ॥
নবদ্বার ঘরে, সুখে শয্যা করে,
হইবে যখন অচেতন ।
তখন আসিবে নিন্দ, চোরে দিবে সিদঁ,
হরে লবে সব রতন ॥

(১৪)

ওহে প্রাণনাথ গিরিবর

ওহে প্রাণনাথ গিরিবর হে,
ভয়ে তনু কাঁপিছে আমার ।
কী শুনি দারুণ কথা, দিবসে আঁধার ॥
বিছায়ে বাঘের ছাল, দ্বারে বসে মহাকাল,
বেরোও গণেশ-মাতা, ডাকে বার বার ।
তব দেহ হে পাষাণ, এ দেহে পাষাণ-প্রাণ,
এই হেতু এতক্ষণ না হল বিদার ॥
তনয়া পরের ধন, বুঝিয়া না বুঝে মন,
হায় হায় একী বিড়ম্বনা বিধাতার ।
প্রসাদের এই বাণী, হিমগিরি রাজরানি,
প্রভাতে চকোরী যেমন, নিরাশা সুধার

  (১৫)   

ডুব দে মন কালী বলে

ডুব দে মন কালী বলে ।
হৃদিরত্নাকরের অগাধ জলে ।।
রত্নাকর নয় শূন্য কখনো,
দু-চার ডুবে ধন না পেলে ।
তুমি দম-সামর্থ্যে এক ডুবে যাও,
কুলকুণ্ডলিনীর কূলে ।।
জ্ঞানসমুদ্রের মাঝে রে মন,
শক্তিরূপা মুক্তা ফলে ।
তুমি ভক্তি করে কুড়ায়ে পাবে,
শিব-যুক্তি মতন চাইলে ।।
কামাদি ছয় কুম্ভীর আছে,
আহারলোভে সদাই চলে ।
তুমি বিবেক-হলদি গায় মেখে যাও,
ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে ।।
রতন মাণিক্য কত, পড়ে আছে সেই জলে
রামপ্রসাদ বলে, ঝম্প দিলে,
মিলবে রতন ফলে ফলে ।।

(১৬)

নিম খাওয়ালে,চিনি বলে

কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হল ।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে রল ॥
মা নিম খাওয়ালে , চিনি বলে, কথায় করে ছল ।
ওমা ! মিঠার লোভে,
তিত মুখে সারা দিনটা গেল ॥
মা খেলবি বলে, ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতল ।
এবার যে খেলা খেলালে মাগো,
আশা না পুরিল ॥
রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায়,
যা হবার তাই হল ।
এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে,
ঘরে নিয়ে চলো। 

(১৭)

এবার কালী তোমায় খাবো

এবার কালী তোমায় খাব ।
(খাব খাব গো দীনদয়াময়ী)
তারা গণ্ডযোগে জন্ম আমার ॥
গণ্ডযোগে জন্ম হলে
সে হয় যে মা-খেকো ছেলে ।
এবার তুমি খাও কী আমি খাই মা,
দুটার একটা করে যাব ॥
ডাকিনী যোগিনী দুটা, তরকারি বানায়ে খাব ।
তোমার মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে,
অম্বলে সম্ভার চড়াব ॥
হাতে কালি মুখে কালি, সর্বাঙ্গে কালি মাখিব ।
যখন আসবে শমন বাঁধবে কষে,
সেই কালি তার মুখে দিব ॥
খাব খাব বলি মাগো উদরস্থ না করিব ।
এই হৃদিপদ্মে বসাইয়ে, মনোমানসে পূজিব ॥
যদি বল কালী খেলে, কালের হাতে ঠেকা যাব ।
(আমার) ভয় কী তাতে কালী বলে
কালেরে কলা দেখাব ॥
কালীর বেটা শ্রীরামপ্রসাদ,
ভালোমতে তাই জানাব ।
তাতে মন্ত্রের সাধন শরীর পতন,
যা হবার তাই ঘটাইব ॥

(১৮)

আয় মন বেড়াতে যাবি

আয় মন বেড়াতে যাবি ।
কালী-কল্পতরুতলে গিয়া, চারি ফল কুড়ায়ে খাবি
প্রবৃত্তিনিবৃত্তি জায়া, তার নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি ।
ওরে বিবেক নামে জ্যেষ্ঠপুত্র,
তত্ত্বকথা তায় শুধাবি ॥
অশুচি শুচিকে লয়ে, দিব্যঘরে কবে শুবি ।
যখন দুই সতীনে প্রীতি হবে,
তখন শ্যামা মাকে পাবি ॥
অহংকার অবিদ্যা তোর,
পিতামাতায় তাড়ায়ে দিবি ।
যদি মোহগর্তে টেনে লয়,
ধৈর্য-খোঁটা ধরে রবি ॥
ধর্মাধর্ম দুটো অজা,
তুচ্ছ হেরে বেঁধে থুবি ।
যদি না মানে নিষেধ,
তবে জ্ঞান-খড়্গে বলি দিবি ॥
প্রথম ভার্যার সন্তানেরে, দূরে রইতে বুঝাইবি ।
যদি না মানে প্রবোধ, জ্ঞানসিন্ধু মাঝে ডুবাইবি ॥
প্রসাদ বলে এমন হলে,
কালের কাছে জবাব দিবি ।
তবে বাপু বাছা বাপের ঠাকুর,
মনের মতন মন হবি ॥

(১৯)

সাধের ঘুমে ঘুম ভাঙে না

সাধের ঘুমে ঘুম ভাঙে না ।
ভালো পেয়েছ ভবে কাল-বিছানা ॥
এই যে সুখের নিশি, জেনেছো কি ভোর হবে না
তোমার কোলেতে কামনা-কান্তা,
তারে ছেড়ে পাশ ফের না ॥
আশার চাদর দিয়াছ গায়,
মুখ ঢেকে তাই মুখ খুল না ।
আছ শীত গ্রীষ্ম সমান ভাবে,
রজক ঘরে তায় কাচাও না ॥
খেয়েছ বিষয়-মদ, সে মদের কি ঘোর ঘোচেনা
আছ দিবানিশি মাতাল হয়ে,
ভ্রমেও কালী বল না ॥
অতি মূঢ় প্রসাদ রে তুই, ঘুমায়ে আশা পুরে না
তোর ঘুমে মহা ঘুম আসিবে,
ডাকিলে আর চেতন পাবেনা ॥

(২০)

মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি

শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি ।
(ভবসংসারে বাজারের মাঝে)
ওই যে মন-ঘুড়ি, আশা-বায়ু,
বাঁধা তাহে মায়া-দড়ি ॥
কাক গণ্ডি মণ্ডি গাঁথা, তাতে পঞ্জরাদি নাড়ি ।
ঘুড়ি স্বগুণে নির্মাণ করা, কারিগরি বাড়াবাড়ি ॥
বিষয়ে মেজেছে মাজা, কর্কশা হয়েছে দড়ি ।
ঘুড়ি লক্ষে দুটা-একটা কাটে,
হেসে দেও মা হাতচাপড়ি ॥
প্রসাদ বলে দক্ষিণা বাতাসে, ঘুড়ি যাবে উড়ি ।
ভবসংসার-সমুদ্র পারে, পড়বে যেয়ে তাড়াতাড়ি ॥

(২১)

মা হওয়া কি মুখের কথা

মা হওয়া কি মুখের কথা ।
(কেবল প্রসব করে হয়না মাতা !)
যদি না বুঝে সন্তানের ব্যথা ॥
দশ মাস দশ দিন, যাতনা পেয়েছেন মাতা ।
এখন ক্ষুধার বেলা সুধালে না,
এল পুত্র গেল কোথা ॥
সন্তানে কুকর্ম করে, বলে সারে পিতামাতা ।
দেখে কাল প্রচণ্ড করে দণ্ড,
তাতে তোমার হয় না ব্যাথা ॥
দ্বিজ রামপ্রসাদ বলে, এ চরিত্র শিখলে কোথা ।
যদি ধর আপন পিতৃধারা,
নাম ধোরো না জগন্মাতা ॥

(২২)

মা বলে আর ডাকব না

মা মা বলে আর ডাকব না ।
ওমা, দিয়েছ দিতেছ কতই যন্ত্রনা ॥
ছিলেম গৃহবাসী, বানালে সন্ন্যাসী,
আর কী ক্ষমতা রাখো এলোকেশী ।
ঘরে ঘরে যাব, ভিক্ষা মেগে খাব,
মা বলে আর কোলে যাব না ॥
ডাকি বারে বারে মা মা বলিয়ে,
মা কি রয়েছো চক্ষুকর্ণ খেয়ে ।
মা বিদ্যমানে এ দুঃখ সন্তানে,
মা মলে কি আর ছেলে বাঁচে না ॥
ভণে রামপ্রসাদ, মায়ের কি এক সূত্র,
মা হয়ে হলি মা সন্তানের শত্রু ।
দিবানিশি ভাবি, আর কী করিবি,
দিবি দিবি পুনঃ কঠোর যন্ত্রণা ॥

(২৩)

মা বিরাজে ঘরে ঘরে

মা বিরাজে ঘরে ঘরে ।
এ কথা ভাঙিব কি হাঁড়ি চাতরে ॥
ভৈরবী ভৈরব সঙ্গে, শিশু সঙ্গে কুমারী রে ।
যেমন অনুজ লক্ষণ সঙ্গে
জানকী তার সমিভ্যারে ॥
জননি, তনয়া, জায়া, সহোদরা, কী অপরে,
রামপ্রসাদ বলে, বলব কী আর,
বুঝে লও গে ঠারেঠোরে ॥

(২৪)

বসন পরো মা


বসন পরো, বসন পরো, মা গো বসন পরো তুমি ।
চন্দনে চর্চিত জবা, পদে দিব আমি গো ॥
কালীঘাটে কালী তুমি, মা গো কৈলাসে ভবানী
বৃন্দাবনে রাধাপ্যারি, গোকুলে গোপিনী গো ॥
পাতালেতে ছিলে মা গো, হয়ে ভদ্রকালী ।
কত দেবতা করেছে পুজা, দিয়ে নরবলি গো ॥
কার বাড়ি গিয়েছিলে, মা গো কে করেছে সেবা ।
শিরে দেখি রক্তচন্দন, পদে রক্তজবা গো ॥
ডানি হস্তে বরাভয়, মা গো বামহস্তে অসি ।
কাটিয়া অসুরের মুণ্ড, করেছ রাশি রাশি গো ॥
অসিতে রুধিরধারা, মা গো গলে মুণ্ডমালা ।
হেঁট মুখে চেয়ে দেখো, পদতলে ভোলা গো ॥
মাথায় সোনার মুকুট, মা গো ঠেকেছে গগনে ।
মা হয়ে বালকের পাশে উলঙ্গ কেমনে গো ॥
আপনি পাগল, পতি পাগল,
মা গো আরো পাগল আছে ।
ওমা, রামপ্রসাদ হয়েছে পাগল,
চরণ পাওয়ার আশে গো ॥

(২৫)

দুর্গানাম ভুলো না

শ্রীদুর্গানাম ভুলো না ।
ভুলো না, ভুলো না, ভুলো না ॥
শ্রীদুর্গা স্মরণে, সমুদ্র মন্থনে,
বিষপানে, বিশ্বনাথ মল না ॥
যদ্যপি কখনো বিপদ ঘটে,
শ্রীদুর্গা স্মরণ কোরোগো সংকটে ।
তারায় দিয়ে ভার, সুরথ রাজার,
লক্ষ অসিঘাতে প্রাণ গেল না ॥
বিভু নামে এক রাজার ছেলে,
যাত্রা করেছিল শ্রীদুর্গা বলে,
আসিবার কালে, সমুদ্রের জলে,
ডুবেছিল, তাতে (তার) মরণ হল না ॥

(২৬)

মাগো তারা ও শংকরী

মাগো তারা ও শংকরী ।
কোন অবিচারে আমার পরে,
করলে দুঃখের ডিক্রি জারি ॥
এক আসামি ছয়টা পেয়াদা,
বলো মা কীসে সামাই করি ।
আমার ইচ্ছা করে ওই ছয়টারে,
বিষ খাওয়াইয়ে প্রাণে মারি ॥
পেয়াদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র,
তার নামেতে নিলাম জারি ।
ওই যে পান বেচে খায় কৃষ্ণ পানতি,
তারে দিলে জমিদারি ॥
হুজুরে দরখাস্ত দিতে, কোথা পাব টাকাকড়ি ।
আমায় ফিকিরে ফকির বানায়ে,
বসে আছ রাজকুমারী ॥
হুজুরে উকিল যে জনা,
ডিসমিসে তাঁর আশয় ভারী ।
করে আসল সন্ধি সওয়াল বন্দি,
যেরূপে মা আমি হারি ॥
পালাইতে স্থান নাই মা, বলো কীবা উপায় করি ।
ছিল স্থানের মধ্যে অভয়চরণ,
তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি ॥

(২৭) 

মনরে কৃষি কাজ জান না

মন রে কৃষি কাজ জান না
এমন মানবজমি রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা ।
কালী নামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরুপ হবে না ।
সে যে মুক্তকেশীর (মন রে আমার) শক্ত বেড়া,
তার কাছেতে যম ঘেঁষে না ।।
অদ্য অব্দ-শতান্তে বা, বাজাপ্ত হবে জান না ।
আছে একতারে মন, এই বেলা তুই
চুটিয়ে ফসল কেটে নে না ।।
গুরু রোপণ করেছেন বীজ,
ভক্তিবারি তায় সেঁচো না ।
ওরে একা যদি, (মন রে আমার)
না পারিস মন, রামপ্রসাদকে ডেকে নে না ।।

(২৮)

মন কোরোনা সুখের আশা

মন কোরো না সুখের আশা ।
যদি অভয়পদে লবে বাসা ॥
হয়ে ধর্মতনয় ত্যজে আলয়,
বনে গমন হেরে পাশা ।
হয়ে দেবের দেব সদবিবেচক,
তেঁই তো শিবের দৈন্যদশা ॥
সে যে দুঃখী দাসে দয়া বাসে,
মন সুখের আশে বড়ো কসা ।
হরিষে বিষাদ আছে মন,
কোরো না এ কথায় গোঁসা ॥
ওরে সুখেই দুখ দুখেই সুখ,
ডাকের কথা আছে ভাষা ।
মন ভেবেছ কপট ভক্তি করে পুরাইবে আশা ॥
করে কড়ার কড়া তস্য কড়া,
এড়াবে না রতি মাসা ।
প্রসাদের মন হও যদি মন,
কর্মে কেন হও রে চাষা ।
ওরে মনের মতন করো যতন,
রতন পাবে অতি খাসা

(২৯)

সব মাগির খেলা

এই দেখো সব মাগির খেলা ।
মাগির আপ্তভাবে গুপ্তলীলা ।
সগুণে নির্গুণে বাঁধিয়ে বিবাদ,
ডেলা দিয়া ভাঙে ডেলা ।
মাগি সকল বিষয়ে সমান রাজি,
নারাজ হয় সে কাজের বেলা ॥
প্রসাদ বলে থাকো বসে, ভবার্ণবে ভাসায়ে ভেলা ।
যখন জোয়ার আসবে, উজায়ে যাবে,
ভাটিয়া যাবে ভাটার বেলা ॥

(৩০)

কী দিলি শুভ সমাচার 

ওগো রানি ! নগরে কোলাহল, উঠো চলো চলো,
নন্দিনী নিকটে তোমার গো ।
চলো, বরণ করিয়া গৃহে আনি গিয়া,
এসো না সঙ্গে আমার গো ॥
জয়া ! কী কথা কহিলি, আমারে কিনিলি,
কী দিলি শুভ সমাচার ।
তোমায় অদেয় কী আছে, এসো দেখি কাছে,
প্রাণ দিয়া শুধি ধার গো ॥
রানি ভাসে প্রেম-জলে দ্রুতগতি চলে,
খসিল কুন্তলভার ।
নিকটে দেখে যারে, শুধাইছে তারে,
গৌরী কত দূরে আর গো ॥
যেতে যেতে পথ, উপনীত রথ,
নিরখি বদন উমার ।
বলে মা এলে মা এলে, মা কি মা ভুলেছিলে,
মা বলে এ কী কথা মার গো ॥
রথে হতে নামিয়া শংকরী, মায়েরে প্রণাম করি,
সান্তনা করে বার বার ।
দাস কবিরঞ্জনে, সকরুণে ভণে,
এমন শুভদিন আর কার গো ॥

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *